পলাশীর ট্রাজেডি : আশীর্বাদ না অভিশাপ!




২৩ জুন ঐতিহাসিক পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের এই দিনে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য প্রায় দুইশবছরের জন্য অস্তমিত যায়। পলাশীতে সেদিন বাঙালির এই ভাগ্য বিপর্যয় কেন ঘটেছিলÑ এ এক বিরাট প্রশ্ন। আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্র, নাটক, পালাগুলোতে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকেই বড় করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আর পলাশী-পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ শাসন এ অঞ্চলের জন্য অভিশাপ বয়ে এনেছিল, নাকি তা ছিল আশীর্বাদস্বরূপÑ এ বিষয়েও বিতর্কের শেষ নেই।
পলাশীতে যুদ্ধ নামক নাটকের বেশ কিছুদিন পর লর্ড ক্লাইভ বলেছিলেন, পলাশী যুদ্ধে নবাবের পরাজয় এবং আমাদের বিজয়ের পরপর আশপাশের গ্রামের মানুষ যদি ইট-পাথর নিয়ে আমাদের তাড়া করত, তাহলেও আমাদের পরাজয় ছিল নিশ্চিত। প্রশ্ন হল, জনগণ তা করেনি কেন? এই দায় তকালীন জনগণের যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি শাসকবর্গের। তকালীন নবাব পরিবারের জনগণের সঙ্গে সেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি যে, তাদের বিপদের দিনে জনগণ তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। জনগণ পলাশীর যুদ্ধকে অতীতের অন্যান্য গতানুগতিক যুদ্ধের মতোই ভেবে নিয়েছিলÑ এটি রাজায় রাজায় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে তাদের ভাগ্যের কোনরূপ পরিবর্তন হবে না।
পলাশীতে বাঙালির এবং দীর্ঘমেয়াদে উপমহাদেশের জনগণের ভাগ্য বিপর্যস্ত হলেও কোন কোন ঐতিহাসিক একে অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন।
যদুনাথ সরকারের মতে, পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত যায়নি, বরঞ্চ যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিজয়ের ফলে এক নতুন স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়। এই স্বাধীনতাকে তিনি রেনেসাঁর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার মতে, এই রেনেসাঁ ১৪৫৩ সালের কনস্ট্যান্টিনোপল পতনোত্তর ইউরোপের রেনেসাঁর চেয়ে অধিক তাপর্যময়।
স্যার যদুনাথ সরকারের মতামত এবং ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক উপমহাদেশে কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে অনেকেই ইংরেজদের আমাদের পথপ্রদর্শক ও প্রকৃত শুভাকাক্সক্ষী মনে করেন। বিশেষ করে লর্ড ডালহৌসিকে আধুনিক ভারতের জনক বলে অভিহিত করা হয়। কারণ তার আমলেই রেল, টেলিফোন এসেছিল। তাছাড়া ঔপনিবেশিক আমলেই এদেশের মানুষ পাশ্চাত্য সভ্যতা, ইংরেজি সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা বিশেষণ করলে এসব যুক্তি মোটেই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় না। যেসব অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুবিধা তারা এখানে এনেছিল তা এদেশের জনগণের জন্য নয়, তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণকে আরও দৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ভারতের রেলপথের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়Ñ সব রেলপথের গন্তব্য বন্দরের দিকে। এর কারণ এই অঞ্চলে যখন রেলপথ স্থাপন করা হয়, তখন ইংল্যান্ডে শিল্পবিপব চলছিল। আর শিল্পের প্রধান কাঁচামাল সংগৃহীত হতো উপমহাদেশ থেকে। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, পলাশী-পরবর্তী সময়ে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার ফলে বাংলা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামক অদ্ভুত ভূমি-ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এদেশের কৃষক ও জমিদার উভয়কেই জমিহারা করা হয়। কৃষকদের ওপর নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী এখনও গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। এদেশের মানুষকে তারা কতটুকু ঘৃণার চোখে দেখতেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তকালীন শ্বেতাঙ্গদের বিভিন্ন ক্লাবের প্রবেশপথে লাগানো নিষেধাজ্ঞা থেকে। যেখানে লেখা থাকতÑ ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ।এ জন্যই মনে হয় ইংরেজ কবি Kypling বলেছেন ÔThe East is the East, the West is the West, the twin shall never be together


0 comments:

Post a Comment

Share

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More