
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে (মরণোত্তর) স্বাধীনতার সর্বোচ্চ সম্মাননা দিল বাংলাদেশ। সোমবার বঙ্গভবনের দরবার হলে আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে ইন্দিরা গান্ধীর পূত্রবধূ ও কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর হাতে এ সম্মাননা তুলে দেয়া হয়। দরবার হলে প্রায় এক হাজার বিশিষ্ট অতিথির সামনে সোনিয়া গান্ধীর হাতে এ সম্মাননা তুলে দেন রাষ্ট্রপতি জিলুর রহমান।
ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাধীনতার সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি জিলুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী পৃথক বক্তব্য দেন। এছাড়া অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধীর দুর্লভ ফুটেজ ও ভিডিও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দলের নেতা, বিদেশী কূটনীতিক, বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক ও শিল্পী-সাহিত্যিকরা উপস্থিত ছিলেন।
সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি জিলুর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য, গুরুত্বপূর্ণ ও একক অবদানের জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাধীনতার সর্বোচ্চ পদক দেয়ার মাধ্যমে আমরা নিজেরাও সম্মানিত বোধ করছি। আর এ সম্মাননা দিতেই আমরা আজ এখানে সমবেত হয়েছি। রাষ্ট্রপতি বলেন, ইন্দিরা গান্ধী তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি দিয়ে ইতিহাসের ধারা ও পরবর্তী প্রজšে§র ভাগ্যকে প্রভাবিত করেছেন। তিনি সব ধরনের নির্যাতন ও অবিচারের বিরুদ্ধে লাখ লাখ বাংলাদেশী ও ভারতীয়কে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এমনকি স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও তিনি আমাদের সবার আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে আছেন, যা বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থেই সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে প্রেরণা জোগায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য বিস্ময়কর নারী ইন্দিরা গান্ধীর মহান অবদানের ইতিহাস আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজšে§র প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী আমাদের বীর যোদ্ধাদের ট্রেনিংসহ অন্যান্য সহযোগিতা দিয়েছেন। পাকিস্তানের কারাগারে আটকাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তির লক্ষ্যে ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে যে ব্যক্তি সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিয়েছিলেন তাকে সম্মানিত করতে পেরে আমরা আনন্দিত। রাষ্ট্রপতি বলেন, দু’দেশের বর্তমান সরকারের সময় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সবচেয়ে গভীর হয়েছে যা সীমান্ত সমস্যা, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনসহ দীর্ঘদিনের বিরোধপূর্ণ ইস্যুগুলোর সমাধানে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এ সময়ে ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী শুধু আমাদের সহায়তাই করেননি, আমাদের মানসিকভাবে সাহসও জুগিয়েছিলেন। তিনি বলেন. ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে শুধু বিশ্ব জনমত গড়ে তোলেননি, পাকিস্তানের কারাগারে আটক অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তির লক্ষ্যে বিশ্ব চষে বেড়িয়েছিলেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ভারতীয় সেনাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফিরিয়ে নেয়ার কাজটিও ছিল নজিরবিহীন। তিনি বলেন, ইন্দিরা গান্ধী শুধু বাংলাদেশের বন্ধুই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের হিতাকাক্সক্ষী। বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা কোনদিন ভোলার নয়। নিজেও এজন্য ঋণী বলে উলেখ করেন তিনি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ঘটনার উলেখ করে বলেন, এ সময় ইন্দিরা গান্ধী আমাকে এবং বোন শেখ রেহানাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা ছাড়াও তিনি বাংলাদেশের শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ভবিষ্যতে দু’দেশের সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী সোনিয়া গান্ধী ও গান্ধী পরিবারের দীর্ঘায়ু কামনা করেন।
সোনিয়া গান্ধী তার বক্তব্যে বলেন, ইন্দিরা গান্ধী যদি আজ আমাদের মাঝে থাকতেন, তবে এ সম্মাননা পেয়ে তিনি নিশ্চয় পুলকিত হতেন। এ সম্মাননা তাকে আমাদের মাঝে এনে দিয়েছে। নিজের অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে সোনিয়া গান্ধী বলেন, বাংলাদেশে আসার অর্থ শুধু একটি দেশ সফরে আসা নয়, এটি একটি অন্যরকম অনুভূতি। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকালে যখন দিলিতে যাত্রাবিরতি করেন তখন তাকে স্বাগত জানাতে স্বামী রাজীব গান্ধীর সঙ্গে তিনিও বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন বলে জানান সোনিয়া গান্ধী। এসব অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে তিনি আবেগাল্পুত হয়ে পড়েন।
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, আমাদের জন্য আজকের দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, একজন বিদেশী সরকারপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী যে অবদান রেখেছেন তার ভোলার নয়। তিনি আমাদের জন্য অসামান্য কাজ করেছেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখা বিদেশী নাগরিকদের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী সবচেয়ে বড় বন্ধু হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে তৎকালীন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল না, তা বিশ্ববাসীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। দীপু মনি বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজšে§র কাছে বিষয়টির রেকর্ড রাখার জন্য স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজš§ যাতে জানতে পারে ইন্দিরা গান্ধী আমাদের জন্য কী করেছেন। সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান শুরুর প্রায় এক ঘণ্টা আগে বঙ্গভবনে উপস্থিত হন সোনিয়া গান্ধী। রাষ্ট্রপতি জিলুর রহমান বঙ্গভবনে তাকে স্বাগত জানান। এরপর বঙ্গভবনের দরবার হলের দেয়ালে বিভিন্ন চিত্রকর্ম ও স্মারক ঘুরিয়ে দেখান। প্রায় আধা ঘণ্টা রাষ্ট্রপতি জিলুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক শেষে দরবার হলে আসেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে আসেন বিকাল সোয়া ৫টায়। এরপর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সোনিয়া গান্ধীকে নিয়ে দরবার হলে প্রবেশ করেন। দরবার হলে আসন গ্রহণ করে উপস্থিত সবাইকে তিনি স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবিএম তাজুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধীর সম্মাননা পদক গ্রহণ করতে রাজি হওয়ায় সোনিয়া গান্ধীকে ধন্যবাদ জানান তাজুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে সম্মাননা পদক দেয়ার আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম আবদুল আজিজ ইন্দিরা গান্ধীকে দেয়া মানপত্র পাঠ করে শোনান।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখা বিদেশী নাগরিকদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মাননাটি শুধু ইন্দিরা গান্ধীকেই দেয়া হল। এ সম্মাননা পদকটি ১৮ ক্যারেটের ২০০ ভরি স্বর্ণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সৌহার্দ্য, শান্তি ও অর্জনের প্রতীক হিসেবে কদম গাছের নকশা আঁকা এ পদকের নকশা শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ও হাশেম খান। সেগুন কাঠের ফ্রেমে দুই ভাঁজ করা পেটের ওপর এ পদকটি তৈরি করা হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীকে স্বাধীনতার সর্বোচ্চ পদকের বাইরেও দেয়া হয়েছে একটি মানপত্র। মানপত্রে লেখা আছেÑ ‘শুরু থেকেই নানা প্রতিকূলতার পর বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন।
0 comments:
Post a Comment