বৃষ্টির গানে ফুলের গন্ধে





নিস্তব্ধ দুপুরে শাপলা বিল থেকে ভেসে আসে পানকৌড়ির ডাক। গৃহবন্দি মানুষ ভাবে তার অনাগত ভবিষ্যতের কথা। কেউ কেউ স্বপ্ন আঁকেন মনের খাতায়। এমন ঘোরলাগা নান্দনিক সময় বর্ষাকে করেছে বৈচিত্র্যময়। আনমনা প্রকৃতি সেজেছে কদম, কেয়া আর হিজল ফুলের সৌরভে। গ্রীষ্মের খরতাপ কাটিয়ে প্রকৃতিতে এখন বিরাজ করছে
বৃষ্টির øিগ্ধ আবেশ। তাই হঠা করে মন
 গেয়ে উঠতেই পারে, ‘পাগলা হাওয়া বাদল দিনে/পাগল আমার মন জেগে ওঠে/চেনাশোনার কোন বাইরে/যেখানে পথ নাই নাইরে।
এছাড়াও আমাদের আনন্দ, বেদনা, আবেগ, অনুভূতি প্রকাশে বর্ষার উপমা অতুলনীয়। বর্ষার প্রকৃতি সাজে সবুজের আভায়। চারদিকে গাঢ় সবুজের সমারোহ দেখা যায়। প্রকৃতির প্রতিটি পরতে পরতে ফুটে থাকে কদম, কামেনী, মালতি, কলনচাঁপা, বেলি, হিজল, কেয়া ইত্যাদি ফুল। বর্ষার সাজসজ্জায় অন্যতম অনুষঙ্গ হতে পারে ঋতুপ্রধান এই ফুলগুলো। খোঁপায় একটি কদম কিংবা একগুচ্ছ বেলি ফুল আপনার সাজসজ্জায় এনে দিতে পারে বর্ষার নান্দনিকতা।
ফুটেছে বর্ষার ফুল
বর্ষার আরেক জগ হচ্ছে মায়াবী প্রকৃতি। দৃষ্টিটা বাইরে ফেরালেই দেখা যাবে, সবুজ প্রকৃতির বৃক্ষ-সুন্দরী চুপচাপ ভিজছে। পাখিরাও চুপচাপ বৃষ্টি উপভোগ করছে। বর্ষার এসব বিচিত্র অনুভূতিই আমাদের মনকে মাতিয়ে রাখে। ভাবনাগুলোকে এলোমেলো করে দেয়। মন যায় পুষ্পাভিলাষী প্রকৃতির কাছে। আষাঢ়ের প্রথম ভাগেই কদম ফুটতে শুরু করেছে। কদম ছাড়া কি বর্ষা হয়? কদমই বর্ষার সব আয়োজনকে প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরিয়ে তোলে। মিষ্টি ঘ্রাণটাও চারপাশ ভারি করে তোলে। ফুলের নতুন কলি বেশ ছোট, গোলগাল, মসৃণ। দেখতে অনেকটা টেনিস বলের মতো। নানা কারণে এ ফুল কমলেও বর্ষায় এ ফুল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
বর্ষার আরেক ফুল লিলি, দারুণ সুগন্ধ। বর্ষায় ভেজা বাতাসে এর সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। তবে সব সৌন্দর্যের কেন্দ্রবিন্দু শাপলা। ভোরে øিগ্ধ আলোয় তার সৌন্দর্য অসাধারণ। এ সময় মিষ্টি সৌরভও ছড়িয়ে পড়ে। কেয়ার উপস্থিতি ছাড়া বর্ষা রূপহীন, গন্ধহীন। বিভিন্ন ছড়া-কবিতা ও উপমায় কেয়াকে বর্ষার রানী উপাধি দেয়া হয়েছে। কেয়ার তীব্র গন্ধে ভ্রমররা দলবেঁধে ছুটে যায়।
ঝুমকো বর্ষার রূপসী ফুল। লতানো গাছের এ ফুল দেখতে মেয়েদের কানের ঝুমকোর মতো বলেই এমন নাম। ফুল ভারি সুন্দর। পাপড়ির গোড়া নীল, আগার দিক ক্রমশ সাদা। মাঝখানে সাদা বৃত্তটি নীলের মধ্যে বিচিত্রতা তৈরি করে। বাংলার চিরায়ত রূপসী ফুল হিজল। গ্রীষ্মে ফুটতে শুরু করলেও বর্ষায় তার প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
মেঘমেদুর বর্ষায় আমাদের চারপাশে ভিনদেশী ফুলও ফোটে। এর মধ্যে ক্রেব বা ফুরুস ফুলকে সবাই চিনি চেরি ফুল বলে। ল্যাঙ্কাস্টারি ফুরুস নামে আরেকটি ফুল চোখে পড়ে। গন্ধহীন, এসব ফুল রূপের কারণেই বেশ জনপ্রিয়।
বর্ষার øিগ্ধ প্রকৃতিকে মাতিয়ে রাখতে আরও কিছু ফুলÑ নাগলিঙ্গম, হাসনা হেনা, চিলতাফুল, নিশিপদ্মা, বাওবাব, জুঁই, সুখ-দর্শন, চামেলী, হংসলতা, লিলি, সুলতানচাঁপা, পোর্টল্যান্ডিয়া, কাঁঠালিচাঁপা, অপরাজিতা, শিউলি, কাশ শাপলা, বকফুল ইত্যাদি।
ফুলের সাজে আজকের নারী
বর্ষার ফুলগুলো সাজসজ্জায় অন্যতম মাধ্যম হতে পারে। ফ্যাশন ডিজাইনার এবং ফ্যাশন হাউস বিবিয়ানার কর্ণধার লিলি খন্দকার বলেন, আজকাল সাজেও নতুন ঢঙে ব্যবহার করা হচ্ছে এসব ফুল। চুলের খোঁপায় ফুলের মালা দেয়া হলেও এখন হাতেও ফুলের মালা স্থান করে নিয়েছে। বেলি ফুলের শুভ্রতায় আপনার খোঁপা ভরিয়ে তুলতে পারেন ভিন্নরূপে। ওপরে তিন-চারটি বকুল ফুলের মালা দিলে তো কথাই নেই। এছাড়া দুই কাঁধের পাশে বেলি ফুলের মালা ঝুলিয়ে দিতে পারেন। অনেকেই আবার একপাশে দুটি মালা লাগাতে পছন্দ করেন। কাঁঠালিচাঁপা খোঁপার একপাশে গুঁজে দিলে আকর্ষণীয় দেখাবে। বেলি ফুলের মালা কিনতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বাঁধন জানায়, প্রকৃতিতে বর্ষার রূপে নিজেকে সাজাতে ফুল কিনতে এসেছি। ঘর সাজাতেও বেলি, বকুল, কাঁঠালিচাঁপা এ সময় বেশ জনপ্রিয়। যে কোন অনুষ্ঠান বা অভ্যর্থনা দিতে বেলি ফুলের কদর রয়েছে বেশ। গায়েহলুদ থেকে শুরু করে বিয়ের প্রতিটি জায়গা বর্ষার বেলি ফুল যেন অন্যরকম অনুভূতি। গহনায় কাঁঠালিচাঁপা ব্যবহার করছেন অনেকেই। এ ফুলগুলো পাবেন শাহবাগ, কাঁটাবন, বিজয়সরণি, পান্থপথ, গুলশান। এছাড়াও প্রতিটি সিগন্যালে পড়লেই বেলি-বকুল সাজিয়ে বিক্রেতা দৌড়ে আসে। একগুচ্ছ কাঁঠালিচাঁপার দাম ১০-২০ টাকা, বেলির মালা পাবেন প্রতিটি ৫ থেকে ৭ টাকায়। অন্যান্য ফুলের দামও হাতের নাগালে।
উপহারে বর্ষার ফুল
আপনার প্রিয় মানুষটির কোন কারণে চোখের কোণায় অভিমানের ছাপ। এই অভিমান ভাঙাতে পারেন একগুচ্ছ বেলি ফুলের মালা দিয়ে। বর্ষার শুরুতেই ফুলের মালা নিয়ে হাজির হতে পারেন কোন নিকটাÍীয়ের কাছে। মুহূর্তেই ফুটে উঠবে ফুলের মতো সতেজ।
শাহবাগের কবরী পুষ্পালয়ের ফুল বিক্রেতা মান্নু মিয়া জানান, বর্ষা প্রতিবছরের মতো এবারও আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে নানা বৈচিত্র্য নিয়ে। বর্ষা এলেই অনেকেই তার প্রিয় মানুষকে ফুলের মালা উপহার দেন। আমরাও এই মালাগুলো গাঁথি খুব যতœ করে। প্রকৃতির এই অমর সৌন্দর্য ফুলকে ভালোবেসেই কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত চমকারভাবে বলে গেছেনÑ
জোটে যদি মোটে একটি পয়সা/ খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/ দুটি যদি জোটে তবে অর্ধেক/ ফুল কিনে নিও, হে অনুরাগী।
বাংলা কাব্য, গীতিকায় এবং প্রকৃতি বর্ণনায় ফুলকে সাজানো হয়েছে নানাভাবে। গীতিকার ফুলকে ভালোবেসেই লিখেছেন,
গাঁথ গাঁথ সুন্দর কন্যাগো মালবতী মালা/ঝইরে পড়ছে সোনার মালা বকুল গো ঐ না গাছের তলা
ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়েই কবিগুরু চমকারভাবে বলেছেন,
পথপাশে মলিকা দাঁড়াল আসি/বাতাসে সুগন্ধের বাজাল বাঁশি।
কবির চিরচেনা এই আষাঢ় আমাদের মাঝে এখন খুব একটা আসে না। তবুও একটা দৃশ্য ভাবতে পারি, দিনমান আকাশে মেঘের আনাগোনা, হঠা শোঁ শোঁ শব্দে বৃষ্টির আগমন, তারপর কখনও ঝমঝম ধারায় কখনও ইলশেগুঁড়ির মতোÑ মাঝে মধ্যে বাতাসের ঝাঁপটায় আন্দোলিত সতেজ অরণ্য, হিমহিম বাতাসে জুড়িয়ে যায় মনপ্রাণ।

0 comments:

Post a Comment

Share

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More