চলচ্চিত্রে সত্তর দশকে তার আগমন। এ পর্যন্ত প্রায় তিনশ’র বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রকে করেছেন সমৃদ্ধ। কুড়িয়েছেন খ্যাতি। তিনি আমাদের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী ববিতা। পুরো নাম ফরিদা আখতার পপি। পৈতৃক বাড়ি যশোর। শিক্ষিত পরিবারে ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় বেড়ে উঠেছেন। ষাট দশকের শেষদিকে বড় বোন কহিনূর আক্তার সুচন্দা চলচ্চিত্রে আসেন। তার কিছু দিন পরই প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে বিয়ে করেন সুচন্দা। তখন ববিতা কৈশোরে পা রেখেছেন। ওই সময় ববিতা টুকটাক টেলিভিশনে অভিনয় করতেন। ববিতার গ্যামারের কারণে সবাই তখন চলচ্চিত্রে আসার জন্য প্রস্তাব করতে শুরু করলেন। ভগ্নিপতি জহির রায়হান তার ‘জ্বলতে সুরুজ কি নীচে’ ছবিতে প্রথমবারের মতো নায়িকা হিসেবে ববিতাকে কাস্ট করেন। যদিওবা ছবিটি ওই সময় শেষ করতে পারেননি জহির রায়হান। এরপর নুরুল হক বাচ্চু পরিচালিত ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবিতে কাজ করেন। এ ছবিটিও আটকে যায়। পরে জহির রায়হানের ‘সংসার’ ছবি দিয়ে প্রথম চলচ্চিত্রে ববিতার আবির্ভাব হয়। এরপর ভিন্নধাঁচের গল্প নিয়ে এহতেশাম নির্মাণ করেন ‘পীচ ঢালা পথ’। এ ছবি দিয়ে ববিতার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনি টাকা আনা পাই, আনারকলি, স্বরলিপিসহ বেশকিছু ছবিতে অভিনয় করেন।
১৯৭৩ সালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে অঙ্গনা বউয়ের চরিত্রে ববিতা অভিনয় করে গোটা ভারত ও বাংলাদেশে হৈ চৈ ফেলে দেন। এ ছবিটি বার্লিন চলচ্চিত্রে পুরস্কৃত হয়। এ প্রসঙ্গে ববিতা বলেন, ‘তখন আমার বয়স খুব বেশি নয়। এত অল্প বয়সে নামকরা পরিচালকের কাজ করছি। তা বুঝিনি। যখন বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তিনি (সত্যজিৎ রায়) আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন, তখন আমার নাম বিশ্বব্যাপী জানতে পারে।’ সেই থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ববিতার নাম ছড়িয়ে পড়ে।
ক্যারিয়ারের এ পর্যায়ে এসেও তেমন অবসর পান না ববিতা। যেটুকু পান, তার সবটুকুই ব্যয় করেন ছবি দেখে। তিনি বললেন, ‘আমি বিভিন্ন দেশের ছবি দেখি, তবে মানিকদার (সত্যজিৎ রায়) ছবিগুলোই বেশি দেখার চেষ্টা করি। যতবারই দেখি ততবারই নতুন কিছু না কিছু শিখি।’ ববিতার জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় অধ্যায় ‘অশনি সংকেত’। তাতে অভিনয় করতে গিয়ে যেমন মজার মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তেমনি পেয়েছিলেন সম্মান। “আমি তখন সবে ১৫ বছর পার করেছি। বুদ্ধিও তেমন ছিল না। এক সন্ধ্যায় দেখলাম মানিকদা ও ইউনিটের সবাই ‘দুর্গা-দুর্গা’ করে পুজো দিলেন। ওই প্রোডাকশনে দুর্গাদাস নামে একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ভেবেছিলাম মানিকদারা বোধহয় তার নামই করছেন। লোকটি বোধহয় খুব সম্মানীয়। মানিকদাকে বললাম, দাদা, দুর্গা বাবু কি খুব সম্মানীয় যে আপনারা তার নাম করছেন? সেটের সবাই হেসে উঠলেন।”
সে সময় নায়করাজ ছাড়াও সোহেল রানার সঙ্গে জুটি গড়ে তোলেন ববিতা। ওই সময় তাদের জুটির বেশকিছু ছবি জনপ্রিয়তা পায়। পরে জাফর ইকবালের সঙ্গে তার জুটি গড়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে ববিতা বলেন, ‘প্রত্যেকের সঙ্গে জুটি হয়ে কাজ করেছি। কারণ একটাই, ছবিতে ভিন্নতা আনার লক্ষ্যে। দর্শক আমাদের গ্রহণ করেছিল। এক সময় জাফর ইকবালের সঙ্গে আমার ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। তিনি ভালো অভিনেতার পাশাপাশি ভালো গায়ক ছিলেন।’
ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগের ছবিতে কাজ করেছেন ববিতা। পাকিস্তানের নায়ক ফয়সালের বিপরীতে ছবিতে কাজ করেছেন। এ জুটির ‘মিস লংকা’ ছবিটি সে সময় দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। একজন পরিপূর্ণ অভিনেত্রী হওয়ার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত নিজেকে নিয়ে গবেষণা করেছেন ববিতা। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল তিন বছরই জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। এই হ্যাটট্রিকের মূলমন্ত্র কি ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কাজের প্রতি ছিলাম খুবই আগ্রহী। নিজের পছন্দ অনুযায়ী চরিত্রে কাজ করতে ভালোবাসতাম। অভিনয় নিয়ে গবেষণা করতাম। পাশাপাশি প্রচুর ছবি দেখতাম। এভাবেই সাফল্য আমার কাছে ধরা দিয়েছে। অভিনয় শিখে নিজের সেরাটা দিতে পারলেই দর্শক আজীবন মনে রাখবে।’ চলচ্চিত্রে বর্তমান নায়ক-নায়িকাদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখনকার ছেলেমেয়েরা বেশ ট্যালেন্ট। কিন্তু তাদের সেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সময়ে পরিচালকরা কাজ বের করে নিতেন। তখন গিসারিন লাগত না, এমনিতেই চোখ বেয়ে পানি পড়ত। আর এখন? ফিলিংস আনতে হয় না, গিসারিন হলেই হয়। এভাবে চলতে থাকলে ওদের মেধা তো শেষ হয়ে যাবে।’
দুই বছর সেন্সর বোর্ডের সদস্য ছিলেন ববিতা। তখন চলচ্চিত্রের অবস্থা অতটা ভালো ছিল না। অশীলতা ও অস্থিরতা সহ্য করতে না পেরে নিজেই অব্যাহতি নেন। তবে মস্কো ফেস্টিভ্যালের জুরিবোর্ডের সদস্য হয়ে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবতী মনে করেন। তিনি বলেন, ‘সোভিয়েতের তাসকান ও মস্কোয় ট্যাক্সিচালক থেকে শুরু করে ফুল বিক্রেতারা পর্যন্ত আমাকে চেনেন। সেখানে আমার অনেক বিলবোর্ড এখনও আছে। আমার ছবি স্থানীয় ভাষায় ডাবিং করে প্রদর্শিত হয়।’
ভালো কাজের বেলায় পারিশ্রমিকের কথা ভাবেননি ববিতা। অনেক ছবি করেছেন বিনা পারিশ্রমিকে। এসবের একটি শেখ নিয়ামত আলীর ‘দহন’। এটি কার্লোভেরি ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার পেয়েছিল। বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে তার খ্যাতি। স্বীকৃতি পেয়েছেন আন্তর্জাতিক অভিনেত্রী হিসেবে। ছয়বার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বহির্বিশ্ব থেকে পেয়েছেন আরও ৬৩টি পুরস্কার। এ ছাড়া অন্যান্য পুরস্কার তো আছেই। ক্ল্যাসিকাল নাচে তিনি তালিম নিয়েছিলেন ‘বাঁদি থেকে বেগম’ ছবি করার জন্য।
সরকারি অনুদানের ছবি ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ প্রযোজনা করে জাতীয় পুরস্কার পান। তার নিজের প্রযোজিত ছবিগুলোর মধ্যে ‘ফুলশয্যা’, ‘আগমন’, লেডী স্মাগলার’, ‘লটারী’ উলেখযোগ্য। বর্তমানে তার অবসর কাটে একমাত্র ছেলে অনিককে নিয়ে। অনিক কানাডার বেসরকারি ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে।
ছেলেকে সময় দেয়ার পাশাপাশি নিয়মিত ছবিতে অভিনয় করে যাচ্ছেন। এখনও তিনি কিছু চরিত্র খুঁজে বেড়ান। গল্পের মধ্যে ডুবে থাকেন, পেয়েও যান। সম্প্রতি চুক্তিবদ্ধ হওয়া নারগিস আক্তারের ‘পুত্র এখন পয়সাওয়ালা’ ছবিতে নিজের চরিত্রটি খুঁজে পেয়ে দারুণ উলসিত ববিতা। তিনি জানান, এটা সত্যি এখনও চরিত্র খুঁজে বেড়াই। তবে ‘পুত্র এখন পয়সাওয়ালা’ ছবির মতো একটি চরিত্র অনেক দিন ধরে খুঁজছিলাম। আমি খুবই আনন্দিত এ ছবিতে অভিনয় করতে পেরে।
সম্প্রতি ববিতা ইউনিসেফের অর্থায়নে ডিসিআইয়ের শুভেচ্ছাদূত হয়েছেন। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করবেন তিনি। শুভেচ্ছাদূত হওয়া প্রসঙ্গে ববিতা বলেন, ‘এ ধরনের কাজের সুযোগ আমার জীবনের বড় পাওয়া। বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করতে পারলে আমার কষ্ট সার্থক হবে।’
বর্তমানে ববিতা নতুন বেশক’টি ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। শুটিং করছেন মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের ‘এমন তো প্রেম হয়’, রাজু চৌধুরীর ‘মাটি’সহ আরও বেশক’টি ছবির।
তার মতে, দেশ ও মানুষের সেবায় বাকি সময়টুকু কাটাতে চাই। মানুষের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাই একজন অভিনয়শিল্পীর পরম পাওয়া।
ৃ
0 comments:
Post a Comment