
অবশেষে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেল আবদুল কাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র কাদেরকে ডাকাত বানাতে চেয়েছিল পুলিশ। রাজধানীর সেগুনবাগিচার রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। তাও আবার খিলগাঁও থানা পুলিশ নিজের এলাকা ছেড়ে রমনা এলাকায় ঢুকে। রহস্যজনক কারণে পাকড়াও করেই কাদেরের ওপর শুরু হয় বর্বরোচিত নির্যাতন। এ নির্যাতনের চিত্র ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। ওই ঘটনায় ফুঁসে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সোচ্চার হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন সংগঠন। সবার মনে প্রশ্ন জাগে, নির্যাতনের মাত্রা আর কতটা বেশি হলে তাকে বর্বরতা বলা যাবে! কয়েক দিনের টানা আন্দোলনের খবর নজরে আসে হাইকোর্টের।
বৃহস্পতিবার সকালে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) হয়ে কাদেরকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারকে। হাজির হতে বলেন খিলগাঁও থানা ও মোহাম্মদপুর থানার ওসি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও প্রাণরসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যানকে। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে কাদেরকে গতকাল বিকালে হাজির করা হলে আদালতে স্বচক্ষে দেখলেন একজন ছাত্রের ওপর আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র। কাদেরের শরীরে আঘাতের ক্ষতচিহ্ন দেখে আদালতে উপস্থিত সবাই ওসির ওই ধরনের নির্যাতন চালানোর কথা কানাঘুষা করতে থাকেন। অনেকে বলতে থাকেন, ওসির কি কোন সন্তান নেই? এভাবে কি একজন মানুষের ওপর নির্যাতন চালানো যায়?
আদালত এ ঘটনায় খিলগাঁও থানার ওসি হেলাল উদ্দিন, সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) আলম বাদশা ও সহকারী উপ-পুলিশ পরিদর্শক (এএসআই) শহিদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ঘটনা তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা বরখাস্ত থাকবেন। এছাড়া ঘটনা তদন্তের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করতে আইন সচিবের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভাগীয় তদন্তের জন্য পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকেও এ ঘটনা তদন্ত করার জন্য আদালত নির্দেশ দিয়েছেন। সব তদন্ত শেষে তদন্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। তদন্তের জন্য আট সপ্তাহ সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও কারা মহাপরিদর্শকের (আইজি প্রিজন) প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় খরচে তার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এ ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তাকে (অ্যাটর্নি জেনারেল) ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এছাড়া কাদেরের চিকিৎসার সময় তার মা-বাবাকে স্বাধীনভাবে তার কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। আবদুল কাদের যেন ন্যায়বিচার পেতে পারে তার জন্য সংশিষ্ট কোর্ট থেকে তার পক্ষে একজন আইনজীবী নিয়োগ করে দেয়ার ব্যবস্থা করতে এবং সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরুকে সহযোগিতা করতে আদালত নির্দেশ জারি করেছেন।
বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চে উপস্থিত খিলগাঁও থানার ওসি প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে বারবারই মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি কাদেরের নির্যাতনের ঘটনার কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাও প্রদান করতে পারেননি। ডাকাতি কার বাসায় হয়েছে তাও বলতে পারেননি। ছিনতাই হওয়া গাড়ির মালিক কে তাও নির্ধারণ করেননি। এমনকি গাড়ির মালিক কে তা ঠিক করার চিন্তাও করেননি ওসি। তাছাড়া ১৬ তারিখ রাত সাড়ে ৩টায় গ্রেফতারের কথা বললেও এফআইআর দায়ের করেছেন বেলা সাড়ে ১১টায়। এসব বিষয়ে আদালত ব্যাখ্যা চাইলে ওসি কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না দিয়ে বারবারই মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করেছেন। মিথ্যা বলে নিজেই ফেঁসে গেছেন। আদালত বলেছেন, পুলিশ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পুলিশ ছাড়া আমাদের চলে না। তবে আমরা এমন কোন পুলিশ চাই না যারা পুলিশের পোশাক পরে মহান ওই প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি নষ্ট করছে, অপরাধ করছে। আদালতে উপস্থিত মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান এ ঘটনাকে রাষ্ট্রীয় নির্যাতন হিসেবে আখ্যা দিয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মিজানের বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন।
যেভাবে ঘটনার শুরু : ১৫ জুলাই রাতে কাদের তার মা ও বোনকে নিয়ে গুলশানের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার থেকে অনুষ্ঠান শেষে হলি ফ্যামিলি মেডিকেল স্টাফ কোয়ার্টারে তার খালাতো ভাইয়ের বাসায় আসেন। সেখানে রাতে খাওয়া-দাওয়া ও গল্প শেষে মা ও বোনকে রেখে রাত দেড়টার দিকে ঢাবির ফজলুল হক হলে ফেরার জন্য রওনা দেন। হলি ফ্যামিলি থেকে বের হয়ে সেগুনবাগিচার দুর্নীতি দমন কমিশনের সামনে দিয়ে প্রেস ক্লাবের দিকে যাচ্ছিলেন কাদের। এমন সময় পেছন থেকে চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পান কাদের। শব্দ শুনে তিনি দাঁড়িয়ে যান। তারপর পেছন দিক থেকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে কাদেরকে আঘাত করে সাদা পোশাকের পুলিশ। রাস্তার ওপরই কাদেরের ওপর নির্যাতন করে তাকে রক্তাক্ত করে ফেলে পুলিশ। পরে খিলগাঁও থানায় নিয়ে আটকে রাখে। পুলিশের সাজানো গল্প মোতাবেক কাদের এর আগে ছিনতাই হওয়া একটি গাড়িতে করে রাত ৩টার দিকে ডাকাতির চেষ্টা করছিল। এ সময় উত্তেজিত জনতা তাকে মারধর করেছে। পরের দিন বেলা সাড়ে ১১টায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে একটি মামলা দায়ের করে খিলগাঁও থানার এসআই আলম বাদশা। পরে কোর্টে নেয়া হলেও কাদেরকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়নি। এমনকি নির্মমভাবে আহত কাদেরকে কোন চিকিৎসা দেয়ারও ব্যবস্থা করা হয়নি। এ ঘটনা পত্রিকায় এলে বৃহস্পতিবার সকালে হাইকোর্টের উপরোক্ত ডিভিশন বেঞ্চ কাদেরকে হাজির করতে সুয়োমোটো আদেশ দেন। বিকাল সাড়ে ৩টার মধ্যে কাদেরকে নিয়ে হাজির হতে দুই থানার ওসিকে নির্দেশ দেন। সাড়ে ৩টার দিকে ওসি হেলাল উদ্দিন ও মাহমুদ হাইকোর্টে হাজির হয়ে কাদেরকে আনার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে আদালত বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে বিকালের মধ্যে কাদেরকে হাজির করতে আইজি প্রিজনকে নির্দেশ দেন। কাদেরের হাজির হওয়ার আগেই এ ঘটনার ওপর শুনানি শুরু হয়। সরকারের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান এ সময় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদন পাঠ করতে থাকেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, কাদেরকে একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে আটক করা হয়েছে। এ বিষয়ে ওসি হেলাল উদ্দিনকে জিজ্ঞেস করা হলে ওই বক্তব্য সঠিক নয় বলে দাবি করেন। এরপর প্রাণরসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর আমিনুর রশিদকে আদালত কিছু বলতে বলেন। তিনি আদালতকে বলেন, আমি দীর্ঘ সময় কাদেরকে কাছ থেকে দেখেছি, ক্লাস নিয়েছি। সে অনার্স পাস করে এবার মাস্টার্সে। তাকে কখনও উচ্ছৃঙ্খল হতে দেখিনি। সে বিএসএস পিমিনারি পরীক্ষায় টিকেছে। পাশাপাশি মাস্টার্স করছে। সে এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে কোনভাবেই যুক্ত থাকতে পারে না। তিনি কাদেরকে মুক্তি দেয়ার জন্য আদালতের কাছে অনুরোধ জানান। এরই মধ্যে কাদেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়। একটি হুইল চেয়ারে বসিয়ে বিকাল ৫টা ২০ মিনিটের দিকে আদালত কক্ষে ঢোকানো হয় তাকে। এ সময় তার পায়ে ব্যান্ডেজ করা ছিল। তার গায়ের নির্যাতনের চিহ্ন দেখানোর জন্য কাদেরের গেঞ্জি খুলে ফেলা হয়। এ সময় বিচারপতিরাসহ আদালতে উপস্থিত সবাই দেখতে পান নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র। তার সারা পিঠে পিটুনির কালো কালো দাগ। দুই বাহুতে চাপাতির কোপের আঘাত। হাতের নখগুলোতে সুই ঢুকানো হয়েছে ও পিটিয়ে থেঁতলে দেয়া হয়েছে। তাতে জমাট বেঁধে আছে রক্ত। একই অবস্থা পায়ের। হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পিটিয়ে থেঁতলে দেয়া হয়েছে। এসব বীভৎস চিত্র দেখে উপস্থিত আইনজীবীরা আঁতকে ওঠেন। এ সময় আদালত কাদেরের কাছে ঘটনার বিবরণ জানতে চান। কাদের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে অনুষ্ঠান দেখা থেকে শুরু করে গ্রেফতার হওয়া পর্যন্ত ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। কাদের বলেন, ঢাবির শিক্ষার্থীর পরিচয় দেয়ার পর উপস্থিত পুলিশরা বলেন, ঢাবির শিক্ষার্থীরা আরও বেশি ডাকাতি-ছিনতাই করে। এ কথা বলে আমার ওপর আরও বেশি নির্যাতন শুরু করে। নির্যাতনে রাস্তাতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ি। তারপর থানায় নিয়ে ওই রাতে আর মারেনি। পরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওসি হেলাল উদ্দিন এসে আবার পেটান। চাপাতি দিয়ে কোপ দেন। এ পিটুনি ও কোপানোর বিষয়ে আদালত ওসিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি অস্বীকার করেন। এ সময় প্রাণরসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর আমিনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, ঢাবির ছাত্র হওয়াতে তার সহকর্মীরা, শিক্ষকরা বিষয়টি তুলে ধরেছেন। মিডিয়া গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়েছে। নীরবে অনেক তাজা প্রাণ এভাবে পুলিশের নির্যাতনে ঝরে যাচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, একটি নিরীহ ছেলে কেন অন্যায় অত্যাচারের শিকার হবে? তিনি আদালতের কাছে এ ঘটনার একটি সুষ্ঠু সমাধান দাবি করেন। তিনি আদালতকে উদ্দেশ করে বলেন, একটি কাদের নয়, হাজার হাজার কাদের এভাবে অন্যায়ভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অন্তত একটি কাদেরকে দিয়ে নজির স্থাপন করে দেন। আদালত ওসি হেলালকে ডেকে ওইদিন কারা ডিউটিতে ছিলেন তা জানতে চান। ওসি বলেন, সিভিল টিমে এসআই আলম বাদশা, এএসআই শহিদুর রহমান, কনস্টেবল আলিমুদ্দীন ও কামরুল হাসান ডিউটিতে ছিলেন। এই চারজন খিলগাঁও থানার আশপাশে থেকে ধরে এনেছে। তারা নেভি ব- রঙের একটি প্রাইভেটকারে ঘোরাঘুরি করছিল। গাড়ি নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ-১৪৮০৮৫। গাড়িটি আটক করা হয়েছে। এর আগে এই গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা হয়েছিল। আদালত জানতে চান, গাড়ির মালিক কে? জবাবে ওসি বলেন, জানি না। আদালত বলেন, মিথ্যা বলবেন না। মিথ্যা বললে এক্ষুনি পোশাক খুলে নাজিমুদ্দিন রোডে পাঠিয়ে দেব। ওসি এবার বলেন, বিজ্ঞ কোর্টের আদেশে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়েছে। তবে গাড়ির মালিকানা নির্ধারণ হয়নি। আদালত বলেন, মালিকানা নির্ধারণ করবেন না? করলে কয় মাস পরে করবেন? ওসি বলেন, মালিকানা নির্ধারণের প্রয়োজন মনে করিনি। আদালত বলেন, আপনি মিথ্যা বলছেন। আদালত জানতে চান, গাড়ি থেকে কাকে কাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওসি বলেন, মামুন আর কাদেরকে। ঘটনাস্থলে ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করছিল। রাত আনুমানিক ৩টা ৯ মিনিটে। এ সময় উত্তেজিত জনতা তাদের মারধর করে। আদালত জিজ্ঞেস করেন, যারা মেরেছে, তাদের কাউকে গ্রেফতার করেননি কেন? তারা কি গাড়ি ভাংচুর আর নির্যাতন করে অপরাধ করেনি? ওসি বলেন, গ্রেফতার করতে পারিনি। আদালত জিজ্ঞেস করেন, কার বাড়িতে ডাকাতি করছিল। এ সময় ওসি বলেন, ডাকাতি নয়, ডাকাতির চেষ্টা করছিল। আদালত আবারও বলেন, কার বাড়িতে। ওসি বলেন, জানি না। তবে শুনেছি ডাকাত বলে একজন রিকশাওয়ালা চিৎকার করেছে। আদালত জানতে চান, তাহলে তারা কি রিকশাওয়ালার কাছ থেকে ছিনতাই করেছে? আদালত আরও বলেন, আপনি একবার বলেছেন, সন্দেহজনকভাবে খিলগাঁও থানার পাশে ঘোরাফেরা করছিল। আবার বললেন, ডাকাতি করেছে। আবার বললেন, ডাকাতির চেষ্টা করছিল। কোনটি সত্য? জবাবে ওসি বলেন, রাস্তায় সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছিল। আদালত জানতে চান এফআইআর কখন দায়ের করেছেন? জবাবে ওসি বলেন, পরের দিন বেলা সাড়ে ১১টায়। আদালত বলেন, ৮ ঘণ্টা পরে কেন? এর মধ্যে গাড়ি ছিনতাইয়ের বিষয়টি জোগাড় (ম্যানেজ) করেছেন? নইলে এত দেরি কেন? আদালত জানতে চান, এফআইআর দেরিতে করার কি কারণ দেখিয়েছেন? জবাবে ওসি বলেন, মামলার বাদী এসআই আলম বাদশা অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা করেছেন। আদালত বলেন, এভাবে একজন আহত লোককে থানায় নিয়ে গেলেন, অথচ চিকিৎসা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। উপরন্তু তাকে গাড়িতে নিয়ে আসামি ধরার জন্য ঘুরে বেড়ালেন। ওসি বলেন, তাকে ফাস্ট এইড দিয়েছিলাম। আদালত বলেন, আপনি কি ডাক্তার যে ফাস্ট এইড দিলেন। তাছাড়া এফআইআরে যা লিখেছেন, তা তো একটা রাবিশ (আবর্জনা)। এ সময় ওসি বলেন, হাসপাতালে নেয়ার আমাদের কোন দায়িত্ব নেই। জজের অনুমতি ছাড়া নিতে পারি না।
এ সময় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান বলেন, হাসপাতালে নিতে কি জজের অনুমতি লাগে? তখন ওসি বলেন, গ্রেফতারের দিনেই হাসপাতালে নিয়েছিলাম। আদালত জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি কাদেরকে চাপাতি দিয়ে মেরেছেন? জবাবে এই বক্তব্য মিথ্যা বলে দাবি করেন ওসি। আদালত এ সময় বলেন, উত্তেজিত জনতা ডাকাতকে পেটাল। হাত, পা আর পিঠে আঘাত করেছে। মাথায় করেনি। উত্তেজিত জনতা মারলে তো এলোপাতাড়ি মাথায়ও আঘাত করবে। এ সময় আবদুল মতিন খসরু বলেন, আমি কাদেরকে পারিবারিকভাবে চিনি। তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তা। আঙুলগুলো মেরে ফাটিয়ে ফেলেছে। এ ধরনের নির্যাতনের একটা সমাপ্তি হওয়া প্রয়োজন। সে ডাকাতি করতে যায়নিÑ এটা আমি নিশ্চিত। এ ঘটনার বিচার হওয়া উচিত। এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হওয়া দরকার।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান : প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান আদালতকে বলেন, পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে। এটা লজ্জাজনক। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে একজন পুলিশ বলেছে, পুলিশকে লাঠি দেয়া হয়েছে কি চুমো খাওয়ার জন্য? জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য। সেই লাঠিকে ব্যবহার করা হয়েছে একজন ছাত্রের ওপর। তার মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার লংঘন করা হয়েছে। ওসি বলেন, গণপিটুনিতে আহত হয়েছে। তবে যারা গণপিটুনি দিয়েছে, তাদের ধরা সম্ভব হয়নি। বারবার এই গণপিটুনির কথা বলে ৫ জন, ৬ জন করে হত্যা করা হচ্ছে। গণপিটুনিকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা যদি গণপিটুনিকে বৈধতা দেয়ার কাজে উৎসাহ দেন, তাহলে রাষ্ট্রের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি কোথায় যাবে? তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর রাগ-ক্ষোভ অনেক বেশি। বিশেষ করে ঢাবির শিক্ষার্থীদের ওপর। এক-এগারোর পরে আমরা এটা দেখেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, মিনতি করে বলছি, একটি সার্কুলার জারি করেন। যাতে আটকাবস্থায় কোন পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এলে তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত বরখাস্ত করা হবে। এটা করলে আটকাবস্থায় নির্যাতন কমে যাবে। এছাড়া এ রকম একটি নির্দেশ জারি করেন, যাতে উদ্ধার হওয়ার পর অস্ত্রগুলো রেজিস্ট্রি করে রাখা হয়। এর ফলে একই অস্ত্র দেখিয়ে বারবার জনগণকে নির্যাতন করতে পারবে না। সরকার মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে পুলিশ সংস্কারের প্রকল্প নিয়েছে, কিন্তু এটাই কি সংস্কার? এ রকম সংস্কার বন্ধ করতে হবে। এমন সংস্কার করতে হবে যাতে পুলিশ জনগণের বন্ধু হয়। তিনি আদালতের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, কাদেরকে যেসব অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, সে যেন আপনাদের কাছ থেকে সেই অধিকার ফিরে পায়। জামিনের ব্যবস্থা করবেন, সে যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। তিনি আরও বলেন, কাদের রাষ্ট্রের নির্যাতনের শিকার। এর চিকিৎসার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। এর জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনি এত আবেগতাড়িত হবেন না। এটা রাষ্ট্রের নির্যাতন নয়। এটা একটা সুনির্দিষ্ট বিষয়।
এ সময় আদালত বলেন, পুলিশের মানুষকে পেটানোর কোন অধিকার নেই। পেটানোর দায়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রাষ্ট্রে পুলিশ অপরিহার্য। কয়েকজন অসাধু পুলিশের জন্য পুরো পুলিশ বিভাগকে দায়ী করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, এটা সাংবিধানিক আদালত। কাউকে দোষী বা নির্দোষ বলা ঠিক হবে না। আদালত বলেন, আমরা কে দোষী, কে নির্দোষ তা বলব না। তবে এ মুহূর্তে বরখাস্ত না হলে সঠিক তদন্ত হবে না। আমরা তো সাজা দিচ্ছি না। পুলিশ এই সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের ছাড়া সমাজ চলে না। পুলিশ চাই, তবে ভালো পুলিশ চাই।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বরখাস্ত না করে আইজিপির কাছে ছেড়ে দেন। ক্লোজ করে রাজারবাগে রেখে দেবে। নইলে পুলিশ মনোবল হারিয়ে ফেলবে। আদালত বলেন, নৈতিকতাসম্পন্ন পুলিশ মনোবল হারাবে কেন? তাছাড়া রাজারবাগে রাখলে সে তদন্ত প্রভাবিত করতে পারবে। তদন্তের স্বার্থে বরখাস্ত করতে হবে। নইলে অন্য পুলিশরা অপরাধ কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত হবে। পরে আদালত উপরোক্ত নির্দেশনা জারি করেন।
সহপাঠীদের ভিড় : হাইকোর্টের সুয়োমোটো আদেশের কথা শুনে কাদেরের সহপাঠী ঢাবির শিক্ষার্থীরা আদালতে ভিড় জমান। আদালতের আদেশে তারা সন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে বেশ কিছু শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রমনা থানা এলাকায় ঢুকে খিলগাঁও থানা পুলিশের একজন ব্যক্তিকে ধরার ঘটনা যেমন রহস্যজনক, তেমনি রহস্যজনক ছিল ঢাবির প্রক্টর কেএম সাইফুল ইসলামের ভূমিকা। তারা অভিযোগ করেন, বিষয়টিতে হস্তক্ষেপের জন্য তারা প্রক্টরের সহায়তা চান। কিন্তু প্রক্টর পুলিশের ভাষার মতোই কাদেরকে ডাকাত বলে আখ্যায়িত করেন। এ সময় তিনি ছাত্রদের শাসিয়ে বলেন, তোমরা বিষয়টি রাজনৈতিক ইস্যু করার অপচেষ্টা করছ। ছাত্রদের অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে প্রক্টরের গোপন যোগসাজশ রয়েছে। যে কারণে ক্যাম্পাসে অহরহ ছিনতাই, বিভিন্ন স্থানে মাদক ব্যবসা ইত্যাদির ঘটনার পরও প্রক্টরিয়াল টিম ও পুলিশ নীরব থকে। এ সময় তারা পুলিশের সহযোগী হিসেবে প্রক্টরের বিচার দাবি করেন।
0 comments:
Post a Comment