গত বছরের মোটামুটি এই সময়টায়ই এভারেস্টের চূড়ায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ছিলেন মুসা ইব্রাহীম। এ বছর সেখানে উড়ল বাংলাদেশের দ্বিতীয় পতাকা। আর এটি উড়িয়েছেন আমাদেরই কৃতী সন্তান মুহিত। যার পুরো নাম এম এ মুহিত। তার এভারেস্ট জয়ের নানাদিক নিয়ে লিখেছেন ইকবাল খন্দকার ছেলেবেলার মুহিত এম এ মুহিতের ছেলেবেলাটা ছিল খুবই সাটামাটা। অন্য দশটা ছেলের শৈশব কৈশোরের মতোই। তবে তার চরিত্রের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য যে তার ছেলেবেলাকে অন্যদের থেকে খানিকটা আলাদা করে দেয়নি তা কিন্তু না। অন্য ছেলেরা যখন খেলাধুলা আর হাসি আনন্দ নিয়ে ব্যস্ত থাকত, মুহিত তখন আনমনা হয়ে বসে থাকতেন নদীর পাড়ে। নদীর পাল তোলা নৌকা তাকে প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট করত। মাঝে মধ্যে এমনও হয়েছে একটি পাল তোলা নৌকা কাছ থেকে দেখার জন্য তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন নদীর পাড়ে। এতক্ষণ অপেক্ষার পর যখন নৌকাটি আসত, তখন অপেক্ষার সব কষ্ট ভুলে যেতেন তিনি। ডুব দিতেন পাল তোলা নৌকার সৌন্দর্যের মাঝে। মুহিত নদীতে সাঁতরিয়ে øান করার ব্যাপারটিকে খুব উপভোগ করতেন। তবে তার চেয়েও বেশি উপভোগ করতেন তার সমবয়সী ছেলেদের øান করার দৃশ্য। যে জন্য অনেক সময় নিজে øান না করে নদীর পাড়ে বসে থেকে কেবল তাদের øান করার দৃশ্যই দেখতেন। নদী কিংবা পাল তোলা নৌকা যেমন টানত ঠিক তেমনি পাহাড় আর গাছ পালাও খুব টানত মুহিতকে। কাছাকাছি যেসব বনভূমি ছিল, সেখানে তিনি ছুটে যেতেন যখন তখন। সবুজের মেলায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতেন কিছুক্ষণের জন্য। এমনও হয়েছে বাগানে ঘুরতে ঘুরতে তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন। তবু তার ভালো লাগত এজন্য, যেহেতু তিনি সবুজের মাঝেই আছেন। যেখানে তিনি থাকবেন, এর আশপাশে তেমন কোন পাহাড় ছিল না বলে সেই বয়সে পাহাড়ের কাছাকাছি যাওয়া হয়নি তার। তবে পাহাড়ে ওঠার সুপ্ত একটা ইচ্ছে তার মনে সুপ্তই থেকে গেল। এভারেস্টের চূড়ার মতো এত উঁচু চূড়ায় ওঠার স্বপ্ন ওইটুকু বয়সে তিনি দেখতে না পারলেও পাহাড়ে উঠবেন, এই স্বপ্ন তখনই দেখা হয়ে গিয়েছিল তার। তাই টিভিতেও যখন পাহাড়ের ছবি দেখাত, তিনি তাকিয়ে থাকতেন অবাক বিস্ময়ে। চলার পথে বাধা মুহিত তখনও জানেন না এভারেস্টের মায়া তাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরবে। তবে সাধারণ পাহাড়ের মায়া তাকে যতটুকু জড়িয়ে ধরেছিল তাতেই মা বাবার মন খারাপের কারণ হয়ে গেলেন তিনি। তারা বারবার একটা কথাই বলতে লাগলেন অন্যেরা যেভাবে স্বাভাবিক কাজ কর্মে মন দিয়ে থাকে, তিনিও যেন তাই করেন। মুহিত অনেক চেষ্টা করলেন মা বাবার কথা রাখতে। কিন্তু পাহাড়ের প্রেম যার রক্তে মিশে গেছে তিনি কি ইচ্ছে করলেই অন্যদের মত স্বাভাবিক কাজে মন বসাতে পারেন? পারেন না। মুহিত পারলেন না। ঈদ কিংবা অন্যান্য ছুটি ছাটাতে যখন একটু অবসর থাকতেন তখনই তিনি ছুটে যেতেন পাহাড়ে। বন্ধুরাও হয়তো বেড়াতে যেত। তবে সবসময় শুধু পাহাড়ে বেড়ানোর ইচ্ছে কারো মধ্যেই ছিল না। তিনি সেই ইচ্ছেকে মনে লালন করেই চললেন। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে যে অর্থ খরচ হতো, তা নিতান্ত কম ছিল না। তবে এই অর্থ তিনি সহজেই যোগাড় করে ফেলতে পারতেন এই জন্যে, যেহেতু তিনি টুকটাক করে সবসময়ই টাকা পয়সা জমাতেন। অন্য ছেলেরা হয়তো সিগারেট বা চা খেয়ে পয়সা খরচ করতো, তিনি তা না করে পয়সা জমাতেন পরের ছুটিতে আবার পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্যে। ফলে আর্থিক বাধাও আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। এদিকে মা বাবার বাধাটাও হালকা হয়ে এল অনেকটাই। কারণ তারা যখন দেখলেন ছেলেকে এ পথ থেকে আর কোনভাবেই ফেরানো যাবে না, এছাড়া ছেলে যেহেতু খারাপ কোন কাজ করছে না, তখন অনুমতি দিয়েই দিলেন। মা বাবার অনুমতি পেয়ে মুহিতের আনন্দ আর ধরে না। তিনি নতুন উদ্যমে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন পাহাড় থেকে পাহাড়ে। চূড়ান্ত বিজয় ১৯৯৭সালে মুহিতের পরিচয় হয় ইনাম আল হকের সঙ্গে। ইনাম আল হক এর আগেই এন্টার্কটিকাসহ বেশ কিছু জায়গায় অভিযানে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নতুন আশায় বুকে বাঁধেন মুহিত। এতোদিন এভারেস্টে যাওয়ার বিষয়টি শুধু তার কাছে ছিল স্বপ্নের মত। এবার তিনি অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গেলেন তার স্বপ্ন সত্যি হবে। তিনি ইনাম আল হকের কাছ থেকে নানারকম পরামর্শ এবং উপদেশ নিয়ে তৈরী করতে লাগলেন নিজেকে। তিনি সম্পৃক্ত হলেন বিএমটিসি নাম একটি সংগঠনের সঙ্গে। এই সংগঠন থেকে তিনি বিভিন্ন রকম দিক নির্দেশনা সংগ্রহ করতে লাগলেন এভারেস্ট সম্পর্কে। ২০০৪সালে মুসা ইব্রাহীমসহ বেশ কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে তিনি এভারেস্টকে দেখলেন খুব কাছ থেকে। এতো কাছ থেকে এভারেস্টকে দেখার সুযোগ এর আগে তিনি কখনোই পাননি। এভারেস্টে চড়ার ইচ্ছেটি এবার পরিণত হয় শপথে। ২০০৪ এবং ২০০৫সালের বেশ কিছু সময় তিনি কাটান প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে। এরপর আশপাশের অনেক পাহাড়েই তিনি অভিযান চালান সফলতার সঙ্গে। সবশেষে আসে সেই সুবর্ণ সময়। এ বছরের ২১মে সকাল ৭টায় তিনি পৌছে যান এভারেস্টের চূড়ায়। আমাদের লাল সবুজের পতাকাকে তুলে ধরেন পৃথিবীর অন্যতম সুউচ্চ স্থানে। বিজয়ের অনুভূতি মুহিত বলেনÑ মানুষের জীবনে যখন সবচেয়ে বড় বিজয়ের ঘটনাটি ঘটে তখন কেবল সে-ই জানে সে কতটা আনন্দিত হয়। আমার জীবনে এত বড় বিজয়ের ঘটনা আর ঘটেনি। জানি না আবার কোনদিন ঘটবে কিনা। তাই আমি জানি আমি কতটা আনন্দিত হয়েছি। আমি যদি বড় কোন পুরস্কার পেতাম, কখনোই এতোটা আনন্দিত হতাম না। কারণ পুরস্কারের সঙ্গে কেবল আমার ব্যক্তিগত আনন্দ জড়িত থাকতো। কিন্তু এই বিজয়ের সঙ্গে শুধু আমার ব্যক্তিগত আনন্দই জড়িত নয়, জড়িত দেশের ষোল কোটি মানুষের আনন্দ। কারণ আমি আমাদের প্রিয় পতাকাকে উচ্চস্থানে নিয়ে যেতে পেরেছি। জš§ভূমির পতাকাকে উচুতে তুলে ধরতে পারার যে আনন্দ, সেই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মত না। আমি এই পূণ্যমত কাজটি করতে পেরেছি, একথা ভাবতেই গর্বে আমার বুক ভরে যায়।
সংগ্রহে সরওয়ার জামান রতন
0 comments:
Post a Comment