খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও মানি লন্ডারিং মামলা হচ্ছে



দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর পর এবার তার বিরুদ্ধেও মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হতে যাচ্ছে। নতুন এই মানি লন্ডারিং মামলায় তারেক রহমান আরেক দফায় নতুন করে আসামি হচ্ছেন। আসামির তালিকায় আরও আছেন হারিছ চৌধুরী, তার এপিএস জিয়াউল ইসলাম, ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকার এপিএস মনির হোসেন ও নয়াপল্টনের বাসিন্দা সুরাইয়া খানম। মামলা করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলার বাদী দুদকের সহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ। তিনি এর আগেও খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। তার হাতে আরও একটি দুর্নীতির ঘটনা অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে। সেটি হলো ভৈরব সেতু নির্মাণে দুর্নীতি। তবে দুদকের অনুসন্ধানে ভৈরব সেতু নির্মাণে দুর্নীতির সঙ্গে খালেদা জিয়ার কোনও ধরনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের একটি মামলায় ৬ বছরের সাজা দিয়েছে নিু আদালত। আর তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অপর মামলার বিচারপর্ব শুরু হতে যাচ্ছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানকে সম্পূরক চার্জশিটে পলাতক দেখিয়ে আসামি করা হয়েছে। মামলার নথিতে তারেক ও কোকো দুজনই পলাতক। একজন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক অপরজন চার্জশিটভুক্ত পলাতক আসামি। সরকার দুজনকেই দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে।

যে ঘটনায় মানি লন্ডারিং মামলার প্রস্তুতি : জোট সরকারের সময় ২০০৫ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামে ক্যান্টনমেন্টের মঈনুল রোডে খালেদা জিয়ার তদানিন্তন বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করে জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়ে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় দুদক। প্রায় দেড় বছর আগে অনুসন্ধানের জন্য দুদকের পরিচালক নূর আহমদ, সহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ ও উপসহকারী পরিচালক রেজাউল হাসান তরফদারের সমন্বয়ে তিন সদস্যের একটি কমিটিও করে দুদক। ওই কমিটি অনুসন্ধান কাজের জন্য ৩০ কার্যদিবস সময় পায়। কিন্তু প্রায় দেড় বছর ধরে অনুসন্ধান শেষে গেল সপ্তাহে তাদের প্রতিবেদন দুদকে জমা দেয়। তাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তার ছেলে তারেক রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ অন্তত ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজুর সুপারিশ করা হয়। সে অনুযায়ী সহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ বাদী হয়ে মামলাটি রুজু করতে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

মামলায় যে অভিযোগ করা হচ্ছে : খালেদা জিয়াসহ অন্যদের বিরুদ্ধে কেন মামলা করা হবে সে সম্পর্কে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বেশ কিছু তথ্য দেয়া হয়েছে। দুদকের প্রতিবেদনে উলেখ করা হয়Ñ খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তার আবাসস্থল মঈনুল রোডের ঠিকানায় তিন সদস্য বিশিষ্ট জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্ট গঠন করেন। খালেদা জিয়া ছিলেন ট্রাস্টি বোর্ডে ম্যানেজিং প্রধান। আর সদস্য ছিলেন তার ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো। ট্রাস্টের নামে সোনালী ব্যাংক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় শাখায় নগদ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ২০০৫ সালের ৫ জানুয়ারি একটি হিসাব খোলা হয়। দুদকের অভিযোগে বলা হয়, ওই হিসাব খোলার ৮ দিনের মাথায় ১৩ জানুয়ারি থেকে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ দিনে ৮ কোটি টাকার ওপরে জমা হয়। জমা হওয়া এই টাকার মধ্যে বিএনপি দলীয় ফান্ডের ৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা ট্রান্সপার করা হয়। যার মধ্যে তারেক রহমান ও ব্যারিস্টার আমিনুল হকের স্বাক্ষর আসে ৪ কোটি টাকা, তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বিএনপির সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া (বর্তমানে মরহুম) ও বিএনপি ঢাকা জেলা সভাপতি আবদুল মান্নানের স্বাক্ষরে আসে ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া ধানমণ্ডির মেট্রো মেকার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ধানমণ্ডি শাখা থেকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে জমা হয় ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা এবং নগদ ও পে অর্ডারের মাধ্যমে হারিছ চৌধুরীর এপিএস জিয়াউল ইসলামের কাছ থেকে আসা ৫৪ লাখ টাকা জমা হয় জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামের হিসাবে।

অনুসন্ধানকারী টিমের একজন সদস্য জানান, মেট্রো মেকার্স ও হারিছ চৌধুরীর এপিএস যে পরিমাণ টাকা ট্রাস্টের হিসাবে জমা দিয়েছে সেই টাকার কোনো উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি।

দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও মামলার সুপারিশ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জিয়াউর রহমান ট্রাস্টের হিসাবে যে টাকা জমা হয় সেই টাকার মধ্যে ৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা দিয়ে নয়াপল্টনে বিএনপি পার্টি অফিসের বিপরীতে জমি কিনে তা ট্রাস্টের নামে দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়। জমির মালিক সুরাইয়া খানমকে দলিলবিহীন ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ট্রাস্টের পক্ষ থেকে দেয়া হয় বলেও দুদক অভিযোগ আনে। সুরাইয়া খানম কোনও ডকুমেন্টস ছাড়া কেন ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা নিলেন সে বিষয়ে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি বলে প্রতিবেদনে উলেখ করা হয়। সে কারণে তাকেও আসামি করা হচ্ছে। সাদেক হোসেন খোকার এপিএস মনিরকে আসামি করা হচ্ছে এজন্য যে, তিনি টাকা লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে নতুন করে মানি লন্ডারিং মামলা করার উদ্যোগের বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, দুদকের অনুসন্ধানকারী টিমের প্রস্তাবনা ও অনুসন্ধান রিপোর্ট জমা পড়েছে। আমরা তা খতিয়ে দেখছি।

জানা গেছে, ২০০২ সালের মানি লন্ডারিং আইনে ‘পঠিতব্য হিসেবে গণ্য’ করে ২০০৯ সালের মানি লন্ডারিং আইনের ৪(২) ধারায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা করার চিন্তাভাবনা করছে দুদক। অনুসন্ধানকারী টিমও ওই ধারায় মামলা রুজুর জন্য সুপারিশ করেছে। অনুসন্ধান টিমের সদস্য হারুন অর রশিদ যুগান্তরকে বলেন, জিয়াউর রহমান চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে ব্যাংক হিসাবে আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ৫ বার নোটিশ করেছি। কিন্তু তিনি আসেননি। এর আগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে বিদেশ থেকে আর্থিক অনুদান এনে তা আÍসাতের অভিযোগে খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলাটি দেয়া হয়। আর তদন্ত শেষে ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর চার্জশিট দেয়া হয়। চার্জশিটে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক মুখ্যসচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীসহ ৬ জনকে আসামি করা হয়। চার্জশিটে দুদক অভিযোগ আনে যে, এতিমদের নামে আনা ৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা আÍসাৎ করেছেন আসামিরা। এদিকে, দুদকের কাছে তদন্তাধীন ভৈরব সেতু নির্মাণে প্রায় শত কোটি টাকার দুর্নীতির বিষয়েও তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়েছে বলে জানা গেছে । তবে ওই রিপোর্টে খালেদা জিয়াকে আসামি করার প্রস্তাব করা হয়নি।

0 comments:

Post a Comment

Share

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More