মুক্তি পেয়েই নৃশংসতার বর্ণনা দিলেন ঢাবি ছাত্র কাদের




বিনা অপরাধে খিলগাঁও থানার ওসি হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশ আমার ওপর যে অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানায়। ‘আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র’ বলার পর তারা আরও বেশি নির্যাতন করেছে। মোটা লাঠি দিয়ে আমার শরীর পিটিয়ে ফাটিয়ে ফেলেছে। এমন নির্মম নির্যাতনের শাস্তি শুধু সাময়িক বরখাস্ত হতে পারে না। জড়িত পুলিশ সদস্যদের এমন কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে পুলিশ অন্য কোন নির্দোষ ব্যক্তিকে এমন নির্যাতন চালাবার দুঃসাহস না দেখায়। ছিনতাই ও ডাকাতি চেষ্টাসহ কথিত তিন মামলা থেকে আদালতের নির্দেশে বুধবার জামিন পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল কাদের। বিকালে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সাংবাদিকদের সামনে তার ওপর পুলিশের নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে কাদের। কারা সূত্র জানায়, বুধবার দুপুরে ঢাবি ছাত্র কাদেরকে অস্ত্র ও ডাকাতি মামলায় আদালতের জামিন দেয়ার বেলবন্ড বিকাল ৫টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে। জেল সুপার পার্থ গোপাল বণিক ও জেলার মোঃ মাহবুবুল ইসলাম বেলবন্ড যাচাই করে দেখেন। এর পর কারা উপাধ্যক্ষ আবু মুসা কাদেরের বেলবন্ড নিয়ে বিকালেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে যান। বিকাল ৫টা ৫৪ মিনিটে কাদের মুক্তি পায়। আইন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি গঠন : হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ঘটনা তদন্তে আইন মন্ত্রণালয় থেকে যুগ্ম সচিব আশীষ রঞ্জন দাসকে নিয়ে এক সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার তদন্ত কমিটি এখনও গঠন করা হয়নি। অপরদিকে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কাদেরের মা মনোয়ারা বেগম জানিয়েছেন, তার ছেলে এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয়। তাই তাকে এখনই বাড়ি নিয়ে যেতে নিষেধ করেছেন চিকিৎসকরা। তাই চিকিৎসকদের পরামর্শে কাদেরকে একই মেডিকেলের অপর একটি ওয়ার্ডে ভর্তি করার প্রক্রিয়া চলছে।
নির্যাতনের বর্ণনা : বিকালে মুক্তি পাওয়ার পর কাদের তার ওপর খিলগাঁও থানা পুলিশের নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার কাঁদতে থাকেন। কাদের জানায়, ১৬ জুলাই সকালে খিলগাঁও থানার ওসি হেলাল উদ্দিন নিজ হাতে আমাকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করেছেন। চাপাতি দিয়ে তিনি যখন আমাকে আঘাত করেন তখন ওসির কক্ষের মেঝে রক্তে লাল হয়ে যায়। শরীর থেকে অনবরত রক্তপাতের কারণে আমি আতংকিত হয়ে পড়ি। ভেবেছিলাম পুলিশ আমাকে মেরেই ফেলবে। ১৫ জুলাই রাতে গ্রেফতারের বর্ণনা দিতে গিয়ে কাদের বলেন, হলি ফ্যামিলির ডক্টর্স কোয়ার্টারে মা ও ছোট বোনদের রেখে আমি হেঁটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওনা হই। রাত দেড়টার দিকে সেগুনবাগিচার দুদক অফিসের সামনে পৌঁছাই। হঠাৎ পেছন থেকে এক লোক এসে আমাকে লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করে। এ সময় আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। তখন পুলিশের পরিচয় দিয়ে আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় একটি নোহা মাইক্রোবাসের কাছে। কাদের বলেন, তখন দেখি গাড়ির ভেতরে আরেক ব্যক্তিকে (মামুন) ব্যাপক মারধর করছে পুলিশ পরিচয়ধারীরা। আমি তখন নিজের পরিচয় দেই। কিন্তু এতে তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে মারধর করতে থাকে। এ ধরনের আচরণ দেখে আমি মনে করি তারা পুলিশ না। তবে খিলগাঁও থানায় নিয়ে যাওয়ার পর আমি নিশ্চিত হই আসলেই তারা পুলিশ। এরপর আমার মুখ থেকে ছিনতাইকারীর স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য রাতভর দফায় দফায় নির্যাতন করা হয়। মামলার এজাহার লেখার সময় আমার ঠিকানা জানতে চাওয়া হয়। আমি ফজলুল হক হলের ঠিকানা উলেখ করি। কিন্তু তারা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানা লিখতে আপত্তি জানায়। এরপর আমার গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশের নির্মম নির্যাতনের আরও বর্ণানা দিয়ে কাদের বলেন, অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের ফলে আমার শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পিটুনির আঘাতে সারা শরীর ব্যথায় কুঁকড়ে যায়। বারবার পুলিশের কাছে বাঁচার আকুতি জানাই। কিন্তু তারা আমার কোন চিকিৎসা করাননি। পায়ে কোন রকম ব্যান্ডেজ পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আদালতে। বিচারক আমার শারীরের অবস্থা দেখে ফেলতে পারেন বলে আমাকে তার সমানেও হাজির করা হয়নি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে কাদের বলেন, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমার ওপর যারা নির্যাতন করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তাহলে নিরপরাধ কোন ব্যক্তিকে ধরে পুলিশ এভাবে নির্যাতন করার সাহস পাবে না।

0 comments:

Post a Comment

Share

Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More